Blog

বঙ্গবন্ধুর কৃষি আজ বিশ্ব উদাহরণ

 প্রচ্ছদ>> আজকের পত্রিকা >>বাতায়ন >>বঙ্গবন্ধুর কৃষি আজ বিশ্ব উদাহরণ

বঙ্গবন্ধুর কৃষি আজ বিশ্ব উদাহরণ
ড. মো. গিয়াসউদ্দিন মিয়া

০৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আবহমানকালের রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষি, সমাজ, সংস্কৃতি দ্বারা পুষ্ট হয়ে বাঙালি জাতিসত্তার ভ্রূণ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনের ফলস্বরূপ বিকশিত হয়ে একাত্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সুদীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে রচিত হয়েছে বাঙালি জাতির গৌরবান্বিত এক মহান বিজয়ের মহাকাব্য।

সব আন্দোলন-সংগ্রামের মূলে ছিল একটি চেতনা, একটি অনুপ্রেরণা, একটি প্রাণ। তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি একটি স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং একটি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা। তারই নেতৃত্বে মুক্তিপাগল একটি জাতির ত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা।

বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সব পদক্ষেপে মূল শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য।

স্বাধীন বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, এমনকি নিজের বুকের তাজা রক্ত ও নিজ স্বজনদের রক্ত বিলিয়ে বাংলার ইতিহাস রচনা করে গেছেন।

স্বাধীনতার পর এক ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ছিল না কোনো অবকাঠামো, ছিল না কোনো প্রতিষ্ঠানও।

অনেকে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি, আবার অনেকে উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলে আখ্যায়িত করেছিল। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে জাতির উদ্দেশে যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা তিনি তার সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু তার স্বল্পকালীন শাসনামলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জনমানুষের জীবনমান উন্নয়নে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তার দৃষ্টান্ত বিরল। নিপীড়িত, নির্যাতিত, মুক্তিকামী, সংগ্রামী জনগণের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববাসী বরণ করেছিল। তিনি অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন।

দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে একের পর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তার সব কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গোটা বিশ্বের বুকে মর্যাদা ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করা।

বঙ্গবন্ধু গভীরচিত্তে উপলব্ধি করতেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন কৃষি ও কৃষকের সামগ্রিক উন্নতি। আর এজন্য ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদাদান করেন।

সেই ১৩ ফেব্রুয়ারির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেন, ‘শুধু কাগজে-কলমে আর বই পড়েই কৃষিকাজ হয় না। ছোট ভাইয়েরা তোমরা মনে কিছু করবে না।

বই পড়ে তোমরা যা শিখ, গ্রামে যারা অর্থাৎ বুড়ো কৃষক নিজের অভিজ্ঞতায় কম শেখে না। যদি তাদের জিজ্ঞেস করো এ জমিতে কী লাগবে, কতটুকু সার লাগবে, সে নির্ভুল বলে দিতে পারবে। তোমরা পাঁচ বছরে বই পড়ে যা শিখবে না, তার কাছে দেখ উত্তর সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে।

বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু প্রাকটিক্যাল কাজ করতে হবে। প্যান্ট-শার্ট-কোট একটু খুলতে হবে। তা না হলে কৃষিবিপ্লব করা যাবে না। বাংলাদেশে প্যান্ট-শার্ট-কোট ছেড়ে মাঠে না নামলে বিপ্লব করা যাবে না, তা যতই লেখাপড়া করা যাক, তাতে কোনো লাভ হবে না।

গ্রামে যেয়ে আমার চাষী ভাইদের সঙ্গে বসে প্রাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে।’ কৃষি ও কৃষকের প্রতি তার যে হৃদয়ের গভীর টান ছিল সেটা সেদিনের ভাষণে ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে- ‘৯০ শতাংশ কৃষক গ্রামে বাস করে।

গ্রামের দিকে যেতে হবে। আমার ইকোনমি যদি গণমুখী করতে না পারি এবং গ্রামের দিকে যদি না যাওয়া যায়, সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না, কৃষিবিপ্লব হবে না।’

কৃষি ও কৃষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল। সেজন্যই তিনি সবসময় দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলা গঠনে কৃষি ও কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত কৃষিবিদদের কল্যাণে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গোটা কৃষিব্যবস্থাকে ব্যাপক আধুনিকীকরণ ও লাগসই উন্নয়নে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষকের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করে গেছেন, তা সত্যিই আমাদের কৃষিবিদদের জন্য বিশাল গর্বের। আর এজন্যই ‘বঙ্গবন্ধুর মহান দান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’ স্লোগানটি এদেশের প্রতিটি কৃষিবিদের অনুভূতিতে মিশে আছে।

বিশ্ববাসী যে মানুষটিকে ক্যারিশমেটিক লিডার ভাবত, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির উন্নয়নের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করত, সেই মহান ব্যক্তিত্বকে এদেশের কিছু নরপিশাচ, অকৃতজ্ঞ ও স্বাধীনতাবিরোধী হত্যা করে গোটা বাঙালি জাতিকে কলুষিত করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহলের পরিকল্পনামাফিক পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাকে এদেশে বলবৎ করার ষড়যন্ত্রই হল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃত পটভূমি। একাত্তরে বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার বেড়াজালে আবদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ধূলিসাৎ করার টার্গেট হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন লন্ডনের এক বাঙালি সাংবাদিকের কাছে লেখা এক শোকবাণীতে উদ্ধৃত করেন- ‘এটা আপনাদের কাছে অবশ্যই এক বিরাট ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি।

আমার কাছে এক পরম শোকাবহ পার্সোনাল ট্র্যাজেডি।’ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশ যাতে পুনরুজ্জীবিত হতে না পারে এবং বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার অশুভ লক্ষ্য ছিল সেই স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহলটির।

তারপর বিকৃত করা হয় বাংলার সংবিধান ও ইতিহাস। স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করা হয় রাজনীতিতে।

শুধু তা-ই নয়, সেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহলটি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিদর্শন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও হত্যার নিমিত্তে এ আগস্ট মাসে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ইতিহাস ও চেতনাকে মুছে ফেলাই যে তাদের লক্ষ্য ছিল, তার জ্বলন্ত প্রমাণ ১৫ ও ২১ আগস্টের ঘৃণিত হত্যাকাণ্ড। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ ১৫ আগস্টে নিহত সব শহীদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের নিমিত্তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার।

বঙ্গবন্ধুর সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণে তার সুযোগ্য কন্যা সফল রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বহুল প্রশংসিত হচ্ছে।

বর্তমানে শেখ হাসিনা এবং তার সরকার যেভাবে উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন, তা এদেশের ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

তিনি ১৬ কোটিরও বেশি মানুষসহ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন অত্যন্ত শক্ত, দৃঢ় ও সতর্ক পদক্ষেপে। কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু নয়, খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে তারই কৃষিবান্ধব নেতৃত্বে।

কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী চাপ, কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, লবণাক্ততা, খরা, উচ্চ তাপমাত্রা ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাবেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধান, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য শস্যে বিশ্বের গড় উৎপাদন অতিক্রম করে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

বর্তমানে বিশ্বের গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় ৩ টন, আর বাংলাদেশে তা প্রায় ৪ দশমিক ১৫ টন। প্রায় ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

আর সাড়ে ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে শীর্ষ নবম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থান বাংলাদেশের।

বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। সবকিছু মিলিয়ে কৃষিবান্ধব শেখ হাসিনা সরকারের আন্তরিকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ, পরিশ্রমী কৃষক আর মেধাবী কৃষিবিদদের যৌথ প্রয়াসেই বাংলাদেশ এখন কৃষিতে বিশ্ব উদাহরণ।

সবশেষে বলতে চাই, স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ও নির্মম ঘটনাটি একটি অমানবিক ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। বাঙালি জাতিকে ১৫ আগস্টের কলঙ্ক আজীবন বহন করতে হবে।

যেদিন আমরা অপবাদ আর বিভ্রান্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব, সেদিনই সম্ভব হবে তার অসামান্য ঋণের কিঞ্চিৎ পরিশোধ করা।

এ মহান ব্রত সামনে রেখে এবং বঙ্গবন্ধুর দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানটুকু অটুট রাখার লক্ষ্যে এদেশের কৃষিবিদরা কৃষির সার্বিক সাফল্যকে এদেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

প্রফেসর ড. মো. গিয়াসউদ্দিন মিয়া
ভাইস চ্যান্সেলর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
giash1960@gmail.com